পুরাণ মতে মহর্ষি কাশ্যপের পুত্র হলেন কেতু | লক্ষীলাভের জন্য দেবতা আর অসুররা সমুদ্র মন্থনে ব্যস্ত | কিন্তু শুভ শক্তি আর অশুভ শক্তির মিলন বা সহবস্থান কী সম্ভব | তাদের মৈত্রী ভেঙে গেল অমৃত প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই | ছল, কপটতা তো অসুরদের সহজাত প্রবৃত্তি | বিশেষ করে যেখানে অমৃত পান করলে অমরত্ব লাভের হাতছানি | দানব কেতু তাই দেবতাদের সঙ্গে ছদ্মবেশে অমৃতপানে প্রবৃত্ত হল| কিন্তু বিধি বাম | কেতু সূর্য আর চন্দ্রের কাছে ধরা পরে গেল | বিষয়টি জানাজানি হল | অগত্যা ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে কেতুর ধড় থেকে মাথা কেটে ফেললেন | কিন্তু অল্প অমৃত ততক্ষনে দানব কেতু পান করেছেন | সুতরাং ছিন্ন মস্তকেও সে অমর | কেতু নামক দানবের দেহ কেতু নামে আর মস্তক রাহু নামে গ্রহ সমাজে স্থান পেলেন |
কালসর্প যোগ সৃষ্টি হয় রাহু আর কেতুর অবস্থানগত কারণে | এই বিষয়ে পরে আলোকপাত করছি | সর্বপ্রথম রাহু আর কেতুর স্বরূপ -গুনাগুণ জানা যাক | এই বিষয়ে বেদ পুরাণাদি শাস্ত্র আর জ্যোতিষ শাস্ত্র কী বলছেন |
লোকশ্রুতি অনুসারে রাহু ছায়া , গণিতশাস্ত্রমতে ‘চন্দ্রপাত ‘ | তবে পুরাণাদি শাস্ত্রে রাহু কেতুর অনেক উপাখ্যান পাওয়া যায় | মহর্ষি পরাশর , বেদব্যাস , জৈমিনি প্রমুখ ঋষিরা রাহু-কেতুকে গ্রহের মর্যাদা দিয়েছেন | বেদব্যাস রাহু -কেতুর অপূর্ব স্তর আর প্রণাম মন্ত্রও রচনা করেছেন | জাতক / জাতিকার ফল গণনায় রাহু কেতুর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না | ফলিত জ্যোতিষ গণনা রাহু কেতুকে না ধরে করা সম্ভব নয় |
রাহু সব পাপ গ্রহদের থেকে বেশি বলবান | ঘোর কৃষ্ণবর্ণের তাই সে রাত্রিকা স্বরূপ | ‘তম’ শব্দের আড়ালে রয়েছে ঘোর অন্ধকারময় পূর্ণ পাপ রাত্রির রূপ | তাই রাহুর অপর নাম ‘তম ‘| এ সত্ত্বেও রাহু মানুষের ঐশ্বর্যের কারক | এজন্য বাস্তব জীবনে দেখা যায় জাতক -জাতিকার রাশিচক্রে বলবান রাহুই তাকে ঐশ্বর্যশালী আর ক্ষমতাশালী করে | রাহু পাপ গ্রহ ; তাই তিনি মোক্ষকারক নন | রাহু ঘোরতর ভোগবাদী -সংশয়বাদী আর অধার্মিক | তাই রাহুর প্রভাবে মানুষ জড়বাদী বা বস্তুবাদী বা নিরীশ্বরবাদী হয় |
ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্রে রাহু পৃথিবীর ক্ষতিসাধনকারী | তাঁর উদ্দাম কামনা , অন্তহীন বাসনার চির অতৃপ্ত ভাব , চরমতম দেহস্পৃহার উৎকট প্রকাশ , দেহ ক্ষুধার ভোগের চরমে গিয়েও অসুখী | রাহুর একটাই গতি | বক্রগতি | রাহু মানুষের ইন্দ্রিয়কে অবলম্বন করে সদা কামনাবাসনার সমুদ্রে সন্তরণ করতে চায় | শাস্ত্রকারদের মতে , রাহু চণ্ডালগ্রহ | শুভাশুভ ভালোমন্দের বিচারহীন , দয়া-মায়া-মমতা -ক্ষমাহীন , লজ্জা -ঘৃণা -ভয়হীন | চুরি-ডাকাতি- প্রতারণা -ফাঁকি , শিল্পী- অভিনয় ইত্যাদিতে পটু |
এই রাহুই অবস্থান ভেদে দ্রুত ও চমকপ্রদ সাফল্য , অতুল ঐশ্বর্য , অর্থ, বীরত্ব , পরাক্রম দেয় | সঙ্গে আনে সূরা -সুন্দরী ভোগের লালসা , দালালি মনোবৃত্তি , প্রবঞ্চকতা | এইভাবে একসময় সে নিজের তৈরী করা দুঃখ সাগরে ডুব দেয় |
অন্যদিকে কেতু কিন্তু রাহসপূর্ণ গ্রহ | সে ধার্মিক | কেতুর সহায়তায় মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটে ; প্রায় ঈশ্বর-সান্নিধ্য | কেতুর চোখ নেই | তাই রাশিচক্রে তার কোনও দৃষ্টিও নেই | কেতুকে আধ্যাত্মিক গ্রহ বলা যেতে পারে | উদাসীনতা , বৈরাগ্য , নির্জন সাধনায় কেতু সাধকের বিশেষ সাহায্যকারী | সংসার বন্ধন কেটে মুক্তির পথে টেনে নিয়ে যান | তাই মহর্ষি জৈমিনি বলেছেন -‘ কেতঔ কেবলাম |’
অবস্থান ভেদে কেতু জাতক- জাতিকার মুক্তিলাভের পথে বিশেষ সহায়তা করে | বিপরীত ক্ষেত্রে উদ্দেশহীন বৃথা ভ্রমণবিলাসী আর অভিশপ্ত জীবনদানও করে থাকে |
কালসর্প দোষ কী ?
সৃষ্টি ধ্বংসকারী মহাশক্তিই হল কাল | কালের গর্ভে মহা চির নিদ্রায় জগৎসহ সর্বসৃষ্টি নিদ্রিত হল | এটাকেই বলে সৃষ্টি লয় হয়ে যাওয়া | সেই কালরূপী সর্পই হল কালসর্প যা ধ্বংসের প্রতীক | তাই কালসর্প কথাটিই ভীতিপ্রদ | আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্রের জ্যোতিষীদের হাত ধরে যোগটির গুরুত্ব দারুণভাবে বিস্তার লাভ করেছে | মানুষের মধ্যে এই ভীতিপ্রদ যোগটির কুপ্রভাবের কথাও অজানা নয় |
এই যোগটির ফলদাতা রাহু কেতু | মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে এই যোগ – সে স্বাস্থ্যই হোক বা পারিবারিক ক্ষেত্র | বিবাহ বা সন্তান , চাকরি লাভ থেকে কর্মোন্নতি -পদোন্নতি বা ব্যবসায়িক বা পেশাদারি জীবনের প্রতিষ্ঠা , গৃহপরিবেশ থেকে বন্ধু / কর্মপরিবেশ প্রভৃতি সর্বত্র | রাহু বা কেতুর অবস্থানের মধ্যে কোনও একদিকে যদি সূর্যাদি বাকি সাতটি গ্রহের অবস্থানে কালসর্প দোষ সৃষ্টি হয় |
অন্য মতে , রাহু কেতুর কোনও একদিকে সূর্যাদি ছয় গ্রহ এবং অপরদিকে একটি গ্রহ থাকে তাহলে আংশিক কালসর্প সৃষ্টি হয় | এই দোষ কালসর্প দোষের থেকেও খারাপ |
মুক্তির পথ কি ?
জীবনের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কালসর্প দোষ ভীষণ রকমের বাধা সৃষ্টি করে থাকে | মানুষের জীবনের যশ , মান, জনপ্রিয়তা, সম্মান, প্রতিষ্ঠা, ধর্ম জীবনে সিদ্ধিলাভ কালসর্প দোষের কারণে প্রতি মুহূর্তে বাধা প্রাপ্ত হয়ে থাকে | তবে জন্মকুণ্ডলীতে যদি রাহু কেতু অশুভ অবস্থানে থাকে তবেই কাল সর্পদোষের প্রতিকার প্রয়োজন, অন্যথায় এই যোগকে অত বেশি গুরুত্ব দেওয়া নিষ্প্রয়োজন | জীবন যাপনে শান্তিতে সুস্থভাবে থাকতে প্রয়োজনীয়তা অনুসারে কালসর্প দোষের প্রতিকার করান | আত্মবিশ্বাস এবং ভগবৎভক্তি সহকারে যাতে কোনো বাধাই মাথা তুলে না পারে তার জন্যে প্রত্যেক দিন শিবের জল অভিষেক করুন এবং তন্ত্রোক্ত মতে শোধিত কালসর্প দোষ নিবারণ কবচ ব্যবহার করলে অবশ্যই শুভ ফল পেতে পারেন |